নিজের বাড়ির স্বপ্ন অনেকের মনেই থাকে, বিশেষ করে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ইচ্ছা। তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অনেকেই দলিল–দস্তাবেজের প্রয়োজনীয়তা, সেগুলোর সঠিক যাচাই–বাছাই এবং নিবন্ধনের প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আসুন জেনে নিই, ফ্ল্যাট কেনার আগে এবং কেনার পর কী কী বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি এবং নিবন্ধনের প্রক্রিয়া কেমন।
ফ্ল্যাট কেনার পূর্বে অবশ্যই ভবনের নকশা অনুমোদন আছে কিনে জেনে নিবেন
ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে হবে যে ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপ্রাপ্ত কি না। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে ভবনের নকশা অনুমোদনের দায়িত্বে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ অন্যান্য শহরে স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই কাজটি করে থাকে। আপনি যেখান থেকে ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, সেই ভবনের নকশা রাজউকের বা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কি না তা যাচাই করতে হবে।
কেবল নকশা অনুমোদন থাকলেই হবে না, ভবনটি সেই নকশা অনুযায়ী তৈরি হয়েছে কি না, সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। কারণ যদি কোনো ভবন অনুমোদিত নকশার বাইরে নির্মিত হয়, তবে রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় ভবনের সেই অবৈধ অংশ ভেঙে দিতে পারে। এই কারণে, ভবনের নকশা এবং বাস্তব অবস্থা যাচাই করার জন্য প্রকৌশলী বা স্থপতি নিয়োগ করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
যেই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির থেকে ফ্ল্যাট কিনবেন সেটি রিহ্যাবের সদস্য কিনা যাচাই
ফ্ল্যাট কেনার আগে যে আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, সেটি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সদস্য কিনা তা নিশ্চিত করে নেওয়া উচিত। রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রচলিত আইন এবং রিহ্যাবের নিজস্ব নিয়মকানুন মেনে চলে। এই কারণে রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে, রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি। রিহ্যাবের সদস্যভুক্ত না হলে পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হলে রিহ্যাবের মাধ্যমে অভিযোগ করার সুযোগ থাকে না।
ফ্ল্যাট ক্রয়ের পূর্বে জমির মালিকানা যাচাই করবেন কিভাবে?
ফ্ল্যাট কেনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফ্ল্যাটটি যে জমির ওপর অবস্থিত, তার মালিকানা সঠিকভাবে যাচাই করা। ফ্ল্যাট বিক্রেতার নামে জমির খতিয়ান রয়েছে কি না, সিএস, এসএ, আরএস এবং অন্যান্য রেকর্ডগুলো যাচাই করা জরুরি। এছাড়াও জমিটি ডেভেলপার কোম্পানি কোনো মালিকের কাছ থেকে কিনে থাকলে, সেই মালিকানা চুক্তিপত্রও ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন দক্ষ আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, যিনি এসব দলিল যাচাই করতে অভিজ্ঞ।
অনলাইনে জমির খতিয়ান যাচাই করুন এই ঠিকানাইঃ https://settlement.gov.bd/khatian/search
আবাসন প্রতিষ্ঠানের অতীত রেকর্ড যাচাই
ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে আবাসন প্রতিষ্ঠানের পূর্বের কার্যক্রম এবং রেকর্ড দেখে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। প্রতিষ্ঠানটি পুরোনো না নতুন, তারা আগে কোনো প্রকল্প করেছে কি না, করলে সেই প্রকল্পগুলোতে কোনো ধরনের অভিযোগ উঠেছে কি না তা রিহ্যাব বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা যেতে পারে। এভাবে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার ঝুঁকি কমানো যায়।
ফ্ল্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়া
ফ্ল্যাট কেনার পরের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ফ্ল্যাট নিবন্ধন। বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট আইন অনুযায়ী, ফ্ল্যাট কেনার পর তিন মাসের মধ্যে ফ্ল্যাটের দখল হস্তান্তর এবং দলিল সম্পাদন করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়। নিবন্ধনের জন্য একজন সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখকের মাধ্যমে বা আইনজীবীর সাহায্যে কাজটি করা যায়।
ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের খরচ ও ফি
বাংলাদেশে একটি ফ্ল্যাট কেনার প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হতে পারে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত খরচ সম্পর্কে সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম প্রধান ব্যয় হল ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি, যা আইনত প্রয়োজন। আমরা কীভাবে বাংলাদেশে একটি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের খরচ হিসাব করা হয় তা বিশ্লেষণ করব এবং কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেব।
বাংলাদেশে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের খরচ কীভাবে হিসাব করবেন
ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের মোট খরচ বিভিন্ন ফি থেকে গঠিত হয়, যার মধ্যে স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অতিরিক্ত চার্জ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এখানে কীভাবে এই খরচ হিসাব করা হয় তা দেখানো হলো:
স্ট্যাম্প ডিউটি:
যদি সম্পত্তির বাজার মূল্য BDT ৫,০০,০০০ বা তার কম হয়, তবে স্ট্যাম্প ডিউটি সম্পত্তির বাজার মূল্যের ১%। যদি বাজার মূল্য BDT ৫,০০,০০০ এর বেশি হয়, তবে স্ট্যাম্প ডিউটি BDT ৫,০০০ প্লাস BDT ৫,০০,০০০ এর উপরে বাজার মূল্যের ২%।
রেজিস্ট্রেশন ফি:
যদি সম্পত্তির বাজার মূল্য BDT ৩০,০০,০০০ বা তার কম হয়, তবে রেজিস্ট্রেশন ফি বাজার মূল্যের ০.৫%। যদি বাজার মূল্য BDT ৩০,০০,০০০ এর বেশি হয়, তবে রেজিস্ট্রেশন ফি হবে BDT ১৫,০০০ প্লাস BDT ৩০,০০,০০০ এর উপরে বাজার মূল্যের ১%।
অতিরিক্ত চার্জ:
এই চার্জ সম্পত্তির বাজার মূল্যের ২% থেকে ৪.৫% পর্যন্ত হয়ে থাকে, যেখানে ১৬০০ বর্গফুটের নিচে ফ্ল্যাটের জন্য ২% এবং এর চেয়ে বড় ফ্ল্যাটের জন্য ৪.৫%ভ্যাট প্রযোজ্য।
ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের মোট খরচ হল এই তিনটি ফি-এর যোগফল।
বাংলাদেশে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন
প্রশ্ন ১: রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফি ছাড়াও কি অন্য খরচ থাকতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে কোর্ট ফি এবং অন্যান্য আইনি খরচ থাকতে পারে, যেমন ফ্ল্যাট হস্তান্তরের খরচ বা অন্য আইনগত প্রক্রিয়া। ফ্ল্যাট নিবন্ধনে অতিরিক্ত কর ছাড়াও স্ট্যাম্প ফি, নিবন্ধন ফি, স্থানীয় সরকার কর এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) পরিশোধ করতে হয়। স্ট্যাম্প ফি দলিলে উল্লেখিত মূল্যের ১.৫ শতাংশ, নিবন্ধন ফি ১ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার কর ২ শতাংশ হয়।
প্রশ্ন ২: রেজিস্ট্রেশন ফি কি শুধু একবারই দিতে হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি একবারই দিতে হয়। তবে যেকোনো পরিবর্তন বা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আবার কিছু খরচ হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোন নথি প্রয়োজন?
উত্তর: ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাধারণত আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, ফ্ল্যাটের দলিল, বায়না পত্র, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দলিলপত্র প্রয়োজন হবে।
ফ্ল্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ধাপ
ফ্ল্যাট নিবন্ধনের জন্য প্রথমে দলিল লেখার কাজটি শেষ করতে হবে। এরপর সব ফি সোনালী ব্যাংকে জমা দিয়ে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হয়। এখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কে উপস্থিত থেকে দলিল এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
ফ্ল্যাট নিবন্ধনের পরের ধাপ
ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কাজ শেষ হলে ক্রেতাকে একটি নামজারি সার্টিফিকেট বা খতিয়ান সংগ্রহ করতে হবে। এটি জমির মালিকানার প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। এই নামজারি করার জন্য সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে আবেদন করতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট ফি জমা দিতে হয়।
ফ্ল্যাট নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা জটিল। তবে সঠিকভাবে দলিলপত্র যাচাই করে এবং আইন অনুযায়ী নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করলে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
ফ্ল্যাট কেনা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি। সঠিকভাবে দলিল যাচাই, নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং সকল আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলা ফ্ল্যাট কেনার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।